168 ) সেহেরির আগে বাইশ খুন (TWENTY TWO MURDERS BEFORE SEHRI)।-Written by Junayed Ashrafur Rahman
168 ) সেহেরির আগে বাইশ খুন (TWENTY TWO MURDERS BEFORE SEHRI)।-Written by Junayed Ashrafur Rahman ✒
একজন ঐতিহাসিক হিসেবে আমি ঐ ব্যাপারে আলোচনা করছি ।
2016 সালের জুলাই মাসের 1 তারিখে ঢাকা শহরের গুলশানে কিছু সাইকোপেথের (মানসিক বিকারগ্রস্থদের) হামলায় দেশি - বিদেশি অনেক মানুষ নিহত হয়েছিলো। এবং এনকাউন্টারে খুনিরাসহ সর্বমোট আটাশ জন (সেহেরির আগে বাইশ জন + সকালে খুনিরা ছয়জন) নিহত হয়।
সেই রাতে আমি গাজীপুরের মৌচাকে ছিলাম।
তখন ছিলো রোজার মাস। আমি চাকরি করতাম প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে।
আমার অফিস ছিলো আলাদা। থাকার রুমও ছিলো আলাদা সেমি ডবল রুমে, মানে সিঙ্গেল রুমের চেয়ে বড় - কিন্তু ডবল রুমের চেয়ে ছোট। আবার কোয়ার্টারের ছয় তলায় আমার জন্য খাওয়ার আলাদা ডাইনিং রুম ছিলো।
এবং অফিসিয়াল কাজের জন্য যে কম্পিউটার ছিলো , সেই কম্পিউটারে আমার চাকরি সংশ্লিষ্ট সকল ফাইল আমি নিজেই পাসওয়ার্ড তৈরি করে লক করে রাখতাম। যেন অন্য কেউ "ভুল করে" আমার ফাইল অপেন করে কোন "ভুল করে" না রাখে।
এই সকল কারণে কোম্পানির আরো প্রায় দুই শ জনের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে চললেও আমার চলতো।
কিন্তু কোয়ার্টারের অন্যান্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতো টিভি রুমে।
আবার কোম্পানির এরিয়া থেকেও আমরা বাইরে তেমন একটা যেতাম না। কেননা , সেই সময়ে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে চন্দ্রা (চান্দুরা) পর্যন্ত যেতে প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা , এমনকি আরও বেশি সময় লাগতো রোডের বিভিন্ন কাজের কারণে।
আবার মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আসতেও প্রায় পাঁচ ছয় ঘণ্টা সময় লাগতো।
ঐ সকল কারণে আমরা মুসলমানরা শুধু জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য এরিয়ার বাইরে বের হতাম। তবে , রাস্তার প্রচণ্ড যানজটের কারণে কাছের মসজিদে নামাজ পড়তাম।
🌟 সেই রাতে আমি অন্যান্যদের সঙ্গে টিভি দেখি প্রায় সাড়ে দশটার সময়। তারপরে আমার থাকার রুমে গিয়ে ঘুমাই।
এরপরে প্রায় সোয়া তিনটার সময় সেহেরি খাওয়ার জন্য ছয় তলায় ডাইনিংয়ে যাই। বেসিনে হাত - মুখ ধুয়ে খাবার খাই।
প্রায় পৌনে চারটার সময় তিন তলায় এসে আমার থাকার রুমে যাওয়ার সময় দেখলাম , টিভি রুমে তিন তলার একজন ভয় আর আতঙ্কে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
পরক্ষণেই আবার আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম ,"কী হয়েছে , আপনি এমন করছেন কেন ?"
ভয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এবং তোতলাতে তোতলাতে (ভয়ের কারণে তোতলামি) বলল ,"গুলশানে কিছু লোক একটা হোটেলে মানুষ খুন করেছে।"
আমি তখন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম ,"তাতে আপনার কী হইছে ? আপনাকে তো কেউ মারেনি।"
এই কথা শুনে আমার কলিগ এবার ভূত দেখার মতো চমকে আমার দিকে তাকালো। আমাকে এই কথা বলতে দেখে প্রায় থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,"এতো মানুষ খুন হলো। আর আপনি বলছেন কী হইছে ?"
আমি বললাম ,"এছাড়া আর কী বলবো ?"
তখন আমার কলিগ আমার দিকে তাকিয়ে আরও হতবাক হয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে টিভি রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
🌟 খুনাখুনি ছোটবেলা থেকেই দেখতে দেখতে আমার আর কোন প্রতিক্রিয়াই হয়না।
2004 সালে কোহিনূর এসপি আমার বাড়ির কাছে দুই জনকে গুলি করে খুন করেছিলো , 2010 সালে আমার বাড়ির কাছে আজিজুল কমিশনারকে বাচ্চু সাহেব কুপিয়ে হত্যা করেছিলো , 2014 সালে আমার বাড়ির কাছে মুনসুর সাহেবকে দলীয় বিবাদের কারণে খুন করা হয়েছিলো , আবার 2015 সালের নান্দাইলের বাঁশহাটি গ্রামে ইফতারের পরে সাতজনকে খুন করা হয়েছিলো এবং 2004 থেকে 2006 সাল পর্যন্ত বাংলাভাই আর বুড়া হুজুরের তাণ্ডব তো দেখেছিই।
তাই আমি তখন গাজীপুরের মৌচাকে ছিলাম আর খুন হয়েছে ঢাকার গুলশানে - এতে আমার প্রতিক্রিয়া না হওয়ারই কথা।
🌟 টিভিতে দেখলাম সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে খুনাখুনির পরের অবস্থা।
ঘটনাটা নাকি ঘটেছিলো রাত দশটার আগে - কিন্তু জানাজানি হয় আরও অনেক পরে।
🌟 ঘটনাটা ছিলো এমন ✒
ইফতারের পরে বাংলাদেশের কিছু লোক আর বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন দেশের আরও কিছু লোক হলি আর্টিসান বেকারি ও হোটেলে আসে খাওয়ার জন্য।
কিছুক্ষণ পরে ছয় জন যুবক এসে ওদেরকে জিম্মি করে।
এরপরে একের পর এক কুপিয়ে হত্যা করে।
শুধু তাই না , বরং দুই জন পুলিশ অফিসারকেও ওরা হত্যা করে।
🌟 টিভিতে দেখলাম , পুলিশ - প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা একের পর এক ঘটনাস্থলে আসছেন। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিলো , সে রাতটা যেন পুলিশ - প্রশাসনের ছোট কর্তা আর বড় কর্তাদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিলো।
টিভিতে দেখানো হলো , তখনের আইজিপি শহীদুল সাহেব নিজের বিনয় ভদ্রতাসুলভ বক্তব্যের মাধ্যমে বললেন ,"আমরা খুনিদেরকে এখনও গ্রেফতার করতে পারিনি এবং পরিচয়ও পাইনি। তবে , তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য আকাশ , বিকাশ , প্রকাশ ছদ্মনাম দিয়েছি। তাদের পরিচয় পেলে আমরা তাদের নাম জানাবো।"
মাঝ রাতের ঘটনার কারণে শেষ রাতে দেয়া কথা শহীদুল সাহেব রেখেছিলেন।
যখন খুনিদের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিলো , তখন তাদের নামও প্রকাশ করা হয়েছিলো।
তাদের একজনের নাম আবার নিব্রাশ ইসলাম।
নিব্রাশের ভাগ্য ভালো যে , ওর মা - বাবা ওর নাম টুথব্রাশ রাখে নাই।
আবার র্যাবের উচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষণা করা হলো , "র্যাব অভিযানে যাবে না এবং সকালের আগে কোন অভিযান নয়।"
তবে, সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা এসে কারবাইন রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলো নিব্রাশদেরকে।
আর এভাবেই শেষ হয়েছিলো হলি আর্টিসানের হত্যা ও পাল্টা হত্যার ঘটনা।
🌟 কিছু আলোচনা ✒
খুনিরা নিহত হয়েছে। তাই আমরাও হয়তো আর বিস্তারিত জানতে পারবোনা , কী ঘটেছিলো সেই রাতে ?
কিন্তু আমরা কিছু আলোচনা করতে পারি।
1 ) গুলশান কিন্তু সাধারণ এলাকা না। বরং যারা গুলশানে বসবাস করেন , তিনিদের অনেকেই বাংলাদেশের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত।
আমি কিন্তু এটা বলছিনা যে , গুলশান ছাড়া অন্য এলাকায় ধনাঢ্য ব্যক্তি নাই। বলছি যে , গুলশানের অনেকেই শীর্ষ ধনাঢ্যদের অন্তর্ভুক্ত।
সাধারণত , গুলশানের যে শিল্পপতির বাড়ি নাই , তিনি স্বপ্ন দেখেন গুলশানে একটা বাড়ির মালিক হওয়ার।
আবার , যে শিল্পপতির একটা বাড়ি আছে , তিনিও স্বপ্ন দেখেন আরও কয়েকটা বাড়ির মালিক হওয়ার জন্য।
এমনকি , অনেক আমলা চাকরির শেষে পেনশনের টাকা দিয়ে গুলশানে বাড়ি ক্রয় করার দুঃস্বপ্নও দেখেন।
তাই গুলশানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা একটু বেশিই।
শুধু সেটাই না , গুলশানে অপরিচিত কেউ এলে , সেই তথ্যও পৌঁছে যায় র্যাব , পুলিশ , সিআইডি অথবা ডিবি পুলিশের কাছে।
আবার, অপরিচিত কেউ গুলশানে এসে কোন খাবারের দোকানে যদি অর্ডার করে ,"মামা, গ্রিল করা আস্ত একটা চিকেন দেন , সঙ্গে দুইটা নান রুটি , আর বেশি করে চিকেন সস্ আর লেটুস পাতা দিয়ে সালাদ।"
অর্ডার মতো খাবার দিলেও পুলিশ - প্রশাসনে ঠিকই একটা রিপোর্ট দিয়ে দেয় ,"কোত্থেকে একটা নবাবের পুত এসে জমিদারের মতো আমাদেরকে গালি দিয়ে চিকেন গ্রিলের অর্ডার দিয়েছে। আর এখন রাক্ষসের মতো বসে খাচ্ছে।"
কেননা, ওদের ধারণায় মামা ডাকটা হচ্ছে একটা গালি। মামা মানে মায়ের ভাই , অর্থাৎ বাপের শালা। আবার , মামা ডাকটা সাধারণত ডাকা হয় রিক্সাওয়ালাদেরকে।
অতএব , এটা একটা গালি। তাই ঐ গালিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
আর এমন রিপোর্ট পেলে পুলিশ - প্রশাসনের কর্তারা ঐ নাবাবের পুত জমিদারের পিছনে লাগতেই পারেন।
এটা তো একটা মামুলি ব্যাপার। অনেক মানুষ আছেন , যিনিরা গুলশানে গিয়ে গুলশানেরই কিছু মানুষের মিথ্যা রিপোর্টের কারণে হয়রানের শিকার হয়েছেন।
প্রিয় পাঠক - পাঠিকা , আপনাদের কেউ গুলশানে গিয়ে হয়রানি শিকার হয়েছেন কি ?
তো গুলশানে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে এতো সচেতনতা , তাহলে ছয়টা খুনি যখন গুলশানে গেল , তখন কেউ বুঝতে পারেনি কেন ?
নিব্রাশরা তো আর ভূতের মতো অদৃশ্য হয়ে গুলশানে যায়নি। ছয়টা খুনি অবশ্যই অন্য মানুষদের সামনে দিয়েই গিয়েছে এবং সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে। তাহলে , এই রিপোর্টটা কেন পুলিশ প্রশাসনের কাছে গেল না ?
2 ) নিব্রাশরা ছিলো ছয়জন। অথচ যাদেরকে খুন করা হয়েছে ওরা দেশি - বিদেশি বিশ জনের বেশি।
তো বিশ জনের পনের জন নিব্রাশদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারতো আর অন্য পাঁচজন পুলিশ প্রশাসনের কাছে ঐ ব্যাপারটা জানাতে পারতো। কিন্তু এটা ওরা কেন করলোনা ? - সেটা হয়তো আর জানা হবে না।
কেননা , নিহতরা আর খুনিরা সকলেই মৃত।
3 ) যে দুইজন পুলিশ অফিসার খুন হয়েছে , ওদের কাছে কি পিস্তল অথবা শটগান ছিলো না ?
ওদের তো উচিৎ ছিলো , অস্ত্রসহ নিব্রাশদেরকে খুন করতে দেখে অথবা তেড়ে আসতে দেখে আত্মরক্ষার জন্য নিব্রাশদের হাতে অথবা পায়ে গুলি করে আহত করার। এবং গ্রেফতার করা। কেন ওরা সেটা না করে বরং উল্টো নিব্রাশদের হাতে খুন হলো ? এসকলও হয়তো আর জানা হবেনা।
4 ) 2016 সালের আগেই গুলশানের প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ি , শপিং সেন্টার আর হোটেল ব্যক্তিগতভাবে সিসি কেমেরার আওতায় আনা হয়।
এমনকি , গুলশানের যুবলীগ নেতা মিল্কীকে যুবলীগেরই আরেক নেতা গুলি করে খুন করেছিলো , সেটাও সিসি কেমেরায় রেকর্ড হয়।
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে , মিল্কীকে ঐ খুনি নিজের কানে মোবাইল ঠেকিয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করছে।
অথচ , হলি আর্টিসানের ঐ খুনাখুনির ভিডিও নাই - আছে শুধু বাইরের ভিডিও। শুধু কি বাইরেই কেমেরা ছিলো ? ভিতরে কি কোন কেমেরা ছিলোনা ?
5 ) পোস্ট মর্টেমের পরে জানা হয় , নিব্রাশরা খুন করার আগে কেপ্টাগন নামক এক ধরণের মাদক সেবন করে নিয়েছিলো। কেপ্টাগন তো ইয়াবা - হেরোইনের চেয়ে দুর্লভ মাদক। নিব্রাশরা কোথায় পেল কেপ্টাগন ?
"চোরাবালি" সিনেমাতে দেখানো হয়েছে গুলশানে ইয়াবা চোরাকারবারের অনুমতির দৃশ্য। তাহলে গুলশানে কি কেপ্টাগনেরও চোরাকারবার হয় ?
এটাও হয়ত জানা হবেনা। কেননা , নিব্রাশরা মৃত।
6 ) আমার কাছে একটা ব্যাপার অদ্ভুত মনে হয়েছে , খুন করার পরে যথেষ্ট সময় ছিলো পালিয়ে যাওয়ার , অথচ নিব্রাশরা পালিয়ে যায়নি।
এটা কি কেপ্টাগন খাওয়ার কারণেই করেছিলো ?
নাকি , খুন করার পরে নিব্রাশরা বসে বসে কোরাস কণ্ঠে গান গেয়েছিলো, কাল সারারাত ছিল স্বপ্নের রাত ......।
এটাও হয়ত আর জানা হবেনা।
7 ) নিব্রাশরা কোন সংগঠনের লোক ছিলো ? সেটা কিন্তু এখনও নিশ্চিত হয়নি।
কারো মতে , ইরাককেন্দ্রীক আইএসের সদস্য আবার কারো মতে , নব্য জেএমবির সদস্য।
কিন্তু একজন ঐতিহাসিক হিসেবে আমি মনে করি , নিব্রাশরা নব্য জেএমবি নামেই হউক অথবা বুইড়্যা জেএমবি হউক - ইয়াবা খেয়ে হউক অথবা কেপ্টাগন খেয়েই হউক , ওরা কিন্তু সাইকোপেথ।
এবং পরে এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে। এটাই মূল ঘটনা।
Comments
Post a Comment